তালিপাম



সম্ভবত ২০১০ সালের কথা। তখন সম্ভবত ক্লাস ফাইভের ছাত্র। বাসায় টেলিভিশন না থাকার দরুন নিয়মিত পত্রিকা নেওয়া হতো। এমনই একদিন প্রথম আলোতে একটা চমৎকার সংবাদ পেলাম। একটা গাছ নাকি মারা যাবে। সেটা পৃথিবীতে ওই প্রজাতির শেষ বংশধর, আবার ফল দিয়েই মারা যাবে। তাই সংরক্ষণে সক্ষম না হলে এটাই হবে একটি প্রজাতির পরিসমাপ্তি। এখানে চমৎকার বিষয় হলো গাছটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্যের বাসভবনে সামনে অবস্থিত। তো এর পরের বেশ কয়েকদিন পত্রিকাতে এই গাছটি সম্পর্কে একটা আর্টিকেল থাকত৷ লেখাটা হয়তো এইটুকুই থাকত তবে কিছু মানুষ একে অন্য পর্যায়ে নিয়েছে। তালিপামকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন বৃক্ষপ্রেমি মানুষেরা। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টার এক গল্প।


তালিপাম হলো Arecaceae গোত্রের সদস্য, যা মিয়ানমার, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে দেখা যেত। আকৃতি সাধারণ তালগাছের মতোই, তবে বৈশিষ্ট্যগতভাবে ভিন্ন। প্রায় ৯০ বছরের জীবনে একবার ফুল ও ফল দেওয়ার পরই বৃক্ষটি মারা যায়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইউলিয়াম রক্সবার্গ প্রথম এর সন্ধান পান। তিনি এর নাম দেন ‘করিফা তালিয়েরা’ (Corypha taliera)। ইউলিয়াম রক্সবার্গের সম্মাননায় তার নাম জুড়ে বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয় 'Corypha taliera Roxburgh'। এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ :


জগৎ: Plantae

বর্গ: Arecales

পরিবার: Arecaceae

গণ: Corypha

প্রজাতি: C. taliera

দ্বিপদী নাম: Corypha taliera Roxb. DC.


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মেরও আগে ব্রিটিশ গার্ডেনার রবার্ট প্রাউডলক রমনা জোনকে সাজানোর জন্য বিভিন্ন দুর্লভ উদ্ভিদের সাথে তালিপামের চারাটি রোপণ করেন।

এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের পাশে গাছটি শনাক্ত করেন অধ্যাপক এম সালার খান। সে সময় বীরভুমে আরেকটি গাছ ছিল। ১৯৭৯ সালে শতবর্ষী এই গাছে ফুল দেখা দিলে স্থানীয়রা একে ভূতের আছড় ভেবে বসে। ফলস্বরূপ ফল ধরার আগেই তারা গাছটি কেটে ফেলে। এরপর ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (IUCN) ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটিকে বুনো পরিবেশে বিশ্বের একমাত্র তালিপাম গাছ হিসেবে ঘোষণা করে। 


মূল ঘটনা ঘটে ২০০৮ সালে। অক্টোবরে ১৮ তারিখে প্রথম আলোতে একটা প্রতিবেদন বের হয় গাছটায় ফুল আসার উপক্রম। একে 'মরণফুল' ফুল বলা হয়। অর্থাৎ ফুল থেকে ফল হলেই গাছটি মারা যায়। তালিপামে ফুল আসার পর ২০১০ সালে ফল প্রদান করে গাছটি মারা যায়। গল্পটা হয়তো এখানেই শেষ হতো, তবে পেছনের দৃশ্যগুলোর এটাই শুরু।


এই তালিপাম সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ফুলার রোডের তালিপামটিতে ফুল ফোটার পর আমরা আশঙ্কা করেছিলাম পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে গাছের এ প্রজাতিটি। কারণ ফুল ফোটার পরপরই গাছটি মারা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ীও এ গোত্রের প্রজাতিগুলোর বীজও সচরাচর অঙ্কুরিত হয় না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এ তালিপামগাছটির সব বীজ থেকে চারা হয়। (প্রথম আলো)


আরবরিকালচার থেকে তালিপামের ফল হতে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে চারা প্রদান করতে গিয়ে ব্যর্থ হন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সহ-উপাচার্যের বাসভবনের মালি জাহাঙ্গীর আলম বীজ রোপণ পদ্ধতিতে চারা তৈরিতে সক্ষম হন। সম্ভবত তার অবদান বেশি ছিল তালিপামকে বাঁচাতে, তবে গল্পের আসল নায়ক এখনও অনুপস্থিত।


এবার আসা যাক আখতারুজ্জামান চৌধুরীকে নিয়ে, যিনি মিরপুর বাংলা কলেজের রসায়নের সহকারী অধ্যাপক। বৃক্ষপ্রেমী এই মানুষটির মনোযোগ ছিল অন্যদিকে। পিএইচডি গবেষণার জন্য দুর্লভ এবং ঔষধি গুণাগুণ সমৃদ্ধ গাছের খোঁজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের একটি বই থেকে তিনি বুনো তাল বা তালিপাম গাছের কথা জানতে পারেন। এই বুনো তাল পূর্ববাংলার স্থায়ী গাছ। এরপর ২০১০ এ এসে তালিপাম সংরক্ষণের বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগী হন।


তিনি কোনো এক ভোরে গাছের নিচে মাটি থেকে পাঁচটার মতো বীজ সংগ্রহ করেন। সেগুলো বাসায় নিয়ে টবে রোপণের মাস দুয়েকের মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়! এরপর নিয়ম করে প্রতিদিনই গাছের নিচ থেকে মাটিতে পড়ে থাকা ফল সংগ্রহ করতেন। এভাবে প্রায় হাজারখানেক বীজ সংগ্রহ করেন, যার কয়েকশ বীজ রেখে দেন গবেষণার জন্য। তিনি নিজের বাসায় ২০০ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের মেডিসিনাল গার্ডেনে ৩০০-এর মতো বীজ রোপণ করলে প্রায় শখানেক বীজ নষ্ট হয়ে গেল। এর পর তিনি অঙ্কুরোদগম হওয়া চারাগুলো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে মনোযোগী হন।


এরপর থেকে তিনি ৪৮ জেলায় ৩০০ তালিপামের গাছ রোপণ করেন। এরপর মধ্যে এখন ২৫০টির মতো বেঁচে আছে। একশ এর মতো বীজ পাট গবেষণা ইনিস্টিউটে সংরক্ষণ করেন যাতে পরিবর্তে গবেষণার কাজে ব্যবহার সম্ভব হয়। এই গাছের বিশেষ সুবিধা হলো এর কোনো যত্ন লাগে না, আপনি আপনি বড়ো হয় কেউ কেটে না ফেললে।


তার তৈরি তালিপামের চারা রোপণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনসহ অনেকেই। তিনি ব্যক্তিগত আয়ের প্রায় ২০% এই কাজে ব্যয় করেছেন। তার পিএইচডিও সম্পন্ন করেছেন তালিপাম বিষয়ে। তিনি 'বাংলাদেশের বিপন্ন উদ্ভিদ' নামে একটি বইও লিখেছেন। 


তালিপাম গাছটির চারা সারা দেশে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, এগুলোতেও একসময় ফুল ফুটবে, ফল হবে। ঔষধী গুণসম্পন্ন হওয়া গবেষণার পরিধি বাড়বে। তবে তা হয়তো ২১০০ সালের আগে সেভাবে সম্ভব হবে না। তবে মানুষ সচেতন থাকলে ধীরে ধীরে ‘বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি’র তালিকা থেকে গাছটি মুক্তি পাবে।


সোর্সঃ

১.https://www.kalerkantho.com/print-edition/oboshore/2019/10/19/828272

২.https://m.bdnews24.com/amp/bn/detail/environment/1691951

৩.https://www.prothomalo.com/bangladesh/environment/%E0%A6%B6%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%9F%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E2%80%98%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%B2%E2%80%99

৪.https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%AE

৫.https://www.prothomalo.com/amp/story/bangladesh/environment/%E0%A6%B6%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%9F%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E2%80%98%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%B2%E2%80%99


আর্কাইভ

সমস্যা বা ফিডব্যাক জানাতে যোগাযোগ করুন

প্রেরণ