জোনাকি
তারা- একটি দুটি তিনটি করে এলো
তখন- বৃষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া
বইছে এলোমেলো,
তারা- একটি দু’টি তিনটি করে এলো।
থই থই থই অন্ধকারে
ঝাউয়ের শাখা দোলে
সেই- অন্ধকারে শন শন শন
আওয়াজ শুধু তোলে।
— আহসান হাবিব।
গ্রাম বাংলার মানুষেরা একটা ছোট্ট অদ্ভুত প্রাণীর সাথে পরিচিত অবশ্যই থাকবেন। রাতের লোডশেডিং এর সময় ঝাক বেঁধে বাড়ির উঠোনে বা ঝোপের ধারে অথবা পুকুর পাড়ে তারার মিটমিট করে ওড়ে চলে। আলোর এই অদ্ভুত খেলার দৃশ্যটা সত্যিই অপ্রাকৃতিক ও মনোমুগ্ধকর। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নগরায়ন ও দূষণের ফলে আজ এই অদ্ভুত জীবটির সাথে মানুষ তেমন পরিচিত নয়। শহরাঞ্চলের কথা বাদ তো বাদ, গ্রাম্য এলাকাতেও খুব একটা দেখা যায় না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই, এর প্রায় দুই হাজার প্রজাতি আছে, যার মধ্যে সবাই বিলুপ্ত প্রজাতি হিসেবে নাম লিখিয়েছে!
শুরুতে এক নজরে এর বৈজ্ঞানিক শ্রেনীবিন্যাস দেখে নেওয়া যাক :
Kingdom : Animalia
Phylum : Arthropoda
Class : Insecta
Order : Coleoptera
Family : Lampyridae (Latreille, 1817)
জোনাকি মূলত পাখাওয়ালা গুবরে পোকা, যাকে বাংলাতে বলা হয় তমোমণি। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই হাজার প্রজাতির জোনাকির আবাস। জোনাকির সবচেয়ে সুন্দর বিষয়টা হলো এদের নিজস্ব আলো তৈরী করার ক্ষমতা এবং মিটমিট করে জ্বলা। এই আলো মূলত শিকার অথবা যৌনমিলনের উদ্দেশ্য জ্বেলে থাকে। তবে মিটমিট করে জ্বলার বিষয়টাও বিজ্ঞানে এখনও অজানা।
জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মূলত জোনাকির আলো উৎপন্ন হয়ে থাকে। তলপেট থেকে নির্গত এই আলো দেখতে কিছুটা নীলাভ-সবুজ। দের দেহকোষে লুসিফারিন (Luciferin) নামক রাসায়নিক উপাদান থাকে। জোনাকির শরীরের এনজাইম লুসিফারেজর উপস্থিতিতে ওই লুসিফারিন অক্সিজেন, এটিপি আর ম্যাগনেশিয়াম আয়নের মিশ্রনে দেহ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। এই প্রক্রিয়াকে বলে বায়োলুমিনেন্স, যা প্রকৃতিতে অনেক রূপে উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। জোনাকির মজার বিষয় হলো এই আলোর কোনো তাপ থাকে না। বিক্রিয়াই উৎপন্ন হওয়া শক্তির প্রায় পুরোটাই আলো তৈরীতে সহায়তা করে। তাই এই কোল্ড লাইটের জন্য আলো অনেকটা নীলাভ হয়। উৎপন্ন আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হলো ৫১০ - ৬৭০ ন্যানোমিটার। তবে কিছু প্রজাতি আরও কম দৈর্ঘ্যের আলোকতরঙ্গ উৎপন্ন করে থাকে (মানে গাঢ় নীল আলো)। জোনাকির এই আলোকে সবচেয়ে কার্যকরী আলো বলা হয়। প্রকৃতিতে লাল ও সবুজ আলোর জোনাকিও দেখতে পাওয়া যায়।
তবে এই জোনাকির আলোর অসাধারণ দৃশ্য থেকে আজ আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এর মূল কারণ নগরায়ন। রাতের অত্যাধিক আলো বা লাইট পলিউশানে জোনাকিরা প্রজননে অক্ষম হয়ে যায়। কারণ নিজেদের আলোর দ্বারা তারা সঙ্গিকে আকর্ষণের চেষ্টা করে, যা রাতের অতিরিক্ত আলোতে সম্ভব হয় না। আবার ফসলে কীটনাশক ব্যবহারের কারও এদের কমে যাওয়ার একটা বড়ো কারণ।
হয়তো আগামি প্রজন্ম আমাদের থেকে এই প্রাণীটার গল্প শুনবে,
আর অবাক চোখে বাংলার এক হারানো রূপের কতা চিন্তা করবে।
সোর্স:
1.https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%9C%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%80
3. https://m.bdnews24.com/amp/bn/detail/science/1720588
4. https://www.kalerkantho.com/print-edition/education/2019/08/05/800257
রওনক শাহরিয়ার,
মার্চ, ২০২১