গন্ডার: এক দুঃখবহ স্মৃতি
"বাংলাদেশেও একসময় গন্ডার দেখতে পাওয়া যেত" কথাটা প্রথমবার শোনার পর বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম। সত্যিই কি এই বিশাল বপুর প্রাণীটা আমাদের দেশেও থাকত। থাকলেও বিলুপ্ত কীভাবে হলো। বর্তমানে তো চিড়িয়াখানা বাদে কল্পনা করাও দায়। এই গন্ডারের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস 'সুন্দরবনের ইতিহাস’ বইতে লেখক তুলে ধরেছেন। তবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের জন্য সত্যিই দুঃখজনক বিষয়।
গন্ডার মূলত তৃণভোজী একটা প্রাণী, রাইনোসেরোটিডি পরিবারের সদস্য। এটা আকারে ছয় ফুট বা একটু বেশি এবং উচ্চতা পাঁচ ফুটের মতো হয়। সারা পৃথিবীতে মোট গন্ডারের পাঁচটা প্রজাতির দেখা মেলে। যার মধ্যে চারটিই বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত। তবে অবাক করার বিষয় হলো, পাঁচটার মধ্যে তিন প্রজাতির গন্ডারই বাংলাদেশে দেখা মিলত। কালের বিবর্তনে অত্যধিক শিকার, বাসস্থান হারিয়ে আজ কোনো জীবিত গন্ডারের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত এই তিন প্রজাতির গন্ডারের বসতির বিস্তৃতি ছিল যথাক্রমে :
Indian rhinoceros (Rhinoceros unicornis) একশিঙ্গি বড় গন্ডার নেপাল সিকিম থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত।
Javan rhinoceros (Sunda rhinoceros)
সুন্দরবন, যশোর থেকে বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত। সুন্দরবন ও যশোর থেকে শিকার করা এমন ১১টি একশিঙ্গি ছোটো গন্ডার কলকাতা, বার্লিন ও লন্ডন জাদুঘরে ব্রিটিশ শাসন আমলে নিয়ে যাওয়া হয়।
Sumatran (Didermoceros sumatrensis)
দুইশিঙ্গি গন্ডারের আবাস কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ছিল। (প্রথম আলোর অংশ বিশেষ)
সুন্দরবনে গন্ডারদের বিলুপ্তির মূল কারণ ছিল এর অত্যাধিক শিকার করা। গন্ডারের চামড়া, শিং ছিল মূল আকর্ষণে। এছাড়াও আদিবাসীরা গন্ডারের মাংস খেত। তৃণাঞ্চলের ঘাটতিও এদের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। মধ্যযুগে এর চামড়া দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করা হতো। তবে ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজদের প্রমোদ বিনোদনের জন্য ব্যাপক শিকারের ফলে গন্ডার অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। এবং উনবিংশ শতকের শেষে দিকেই গন্ডারের এক কষ্টকর ঘটনা ঘটে।
১৮৬৮ সালে চট্টগ্রামে কোনো এক স্থানে একটা দুই শিং এর গন্ডার চোরাবালিতে আটকে পড়ে। স্থানীয় মানুষ তুলে আটকে রেখে প্রসাশনকে জানায়। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ক্যাপ্টেন হুড ও মি. উইকস আটটি হাতি নিয়ে ১৬ ঘণ্টা কঠোর চেষ্টার পর একে বন্দী করে। তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। অর্থলোভী কর্মকার্তারা পাঁচ হাজার পাউন্ডে লন্ডন চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেয় গন্ডারটিকে। এই দুই শিংয়ের গন্ডারটি বেগম নামে পরিচিতি পায়।
তার একটা ছবিও পাওয়া যায়, যা লন্ডনের এক চিত্রশিল্পী এঁকেছিল।
এই ঘটনার কিছু বছর পর ইংরেজদের হাতে কুমিল্লায় আরেকটা দুই শিংয়ের গন্ডার হত্যা হয়।
তবে শেষ জীবিত গন্ডারটি ছিল এই 'বেগম', দেশে যার জায়গা হয়নি।
তার একটা ছবি-
বিংশ শতাব্দির শুরুর পর আর কোনো জীবিত গন্ডারের খোঁজ মিলেনি। মানুষের দ্বারা এই তিন প্রজাতির গন্ডারের বিলুপ্তি ঘটে। তবে পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে এখনও গন্ডার পাওয়া যায়।
গন্ডার থেকে একটা মজার জিনিস প্রসিদ্ধ। 'গেঁড়াকল' শব্দটা এই গন্ডার (স্থানীয় গেঁড়া) নিধন কল থেকে এসেছে, যা দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষেরা ব্যবহার করে শিকার করত।
সোর্স:
১. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rhinoceros